বাঁদর: স্বভাব, খাদ্যাভ্যাস ও মানুষের সাথে সম্পর্ক বাঁদর পৃথিবীর অন্যতম বুদ্ধিমান ও অভিযোজনশীল প্রাণী।

বাঁদর: স্বভাব, খাদ্যাভ্যাস ও মানুষের সাথে সম্পর্ক বাঁদর পৃথিবীর অন্যতম বুদ্ধিমান ও অভিযোজনশীল প্রাণী।

 বহু বছর ধরে বাঁদর মানুষের নিকটতম আত্মীয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের সাথে বাঁদরের সম্পর্ক গভীর ও বৈচিত্র্যময়। এই প্রতিবেদনে আমরা বাঁদরের স্বভাব, হিংস্রতা, খাদ্যাভ্যাস এবং মানুষের সাথে তাদের সম্পর্কের দিকগুলো তুলে ধরবো। --- বাঁদরের হিংস্রতা: কতটা বিপজ্জনক হতে পারে? বাঁদর সাধারণত সমাজবদ্ধ প্রাণী এবং দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বেশিরভাগ বাঁদর স্বভাবত শান্ত প্রকৃতির হলেও, কিছু পরিস্থিতিতে তারা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে— 1. শিকারী বা শত্রুর আক্রমণের সময় – নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য বাঁদর হিংস্র আচরণ করতে পারে। 2. খাদ্যের অভাব হলে – যখন তাদের খাদ্যের ঘাটতি হয়, তখন তারা মানুষের বসতিতে প্রবেশ করে এবং অনেক সময় খাদ্য ছিনিয়ে নিতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। 3. মানুষের দ্বারা উত্যক্ত হলে – যদি কেউ বাঁদরকে উত্ত্যক্ত করে বা আঘাত করে, তবে তারা আত্মরক্ষার্থে প্রতিশোধ নিতে পারে। 4. প্রজনন মৌসুমে – পুরুষ বাঁদররা প্রজনন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে, যা তাদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হিংস্র করে তোলে। গবেষকদের মতে, বাঁদরের মধ্যে আগ্রাসন প্রধানত টেরিটোরিয়াল (অঞ্চল রক্ষা) ও খাদ্যের জন্য হয়। কিছু প্রজাতি যেমন রিসাস মাকাক (Rhesus Macaque) বা বাবুন (Baboon) তুলনামূলক বেশি আগ্রাসী হতে পারে। --- বাঁদরের প্রধান খাদ্য বাঁদরের খাদ্যাভ্যাস মূলত নির্ভর করে তাদের প্রজাতি ও বাসস্থানের ওপর। সাধারণত বাঁদরের খাদ্য তালিকায় থাকে— ফলমূল (আম, কলা, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি) পাতা ও কচি ডাল ফুল ও বৃক্ষের বাকল শস্যদানা ও বীজ ছোট পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ কিছু প্রজাতির বাঁদর ছোট ছোট সরীসৃপ ও পাখির ডিম খেয়ে থাকে মানুষের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করার প্রবণতাও অনেক বাঁদরের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে, যেসব বাঁদর শহর বা পর্যটনকেন্দ্রের আশেপাশে বসবাস করে, তারা মানুষের কাছ থেকে সহজে খাবার সংগ্রহ করার অভ্যাস গড়ে তোলে। --- মানুষের সাথে বাঁদরের সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকে মানুষ ও বাঁদরের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বাঁদরকে পবিত্র, শুভ বা শয়তানরূপেও বিবেচনা করা হয়। 1. ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বাঁদর হিন্দু ধর্মে হনুমান দেবতা হিসেবে পূজিত হন, যিনি মূলত এক প্রজাতির বাঁদরের প্রতীক। চীনা ও জাপানি সংস্কৃতিতে বাঁদরের উপস্থিতি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। 2. বাঁদর ও বিজ্ঞান বাঁদর মানুষের জিনগতভাবে নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে পড়ে। শিম্পাঞ্জি, বনোবো ও গরিলার সাথে মানুষের ডিএনএর ৯৮%-এর বেশি মিল রয়েছে। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বাঁদরের ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে মানব মস্তিষ্ক, স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার উপর গবেষণার ক্ষেত্রে। 3. বাঁদরের সাথে মানুষের বিরোধ শহরাঞ্চলে বাঁদরের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অনেক সময় তারা বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে এবং খাবার লুট করে, যা মানুষের জন্য সমস্যার কারণ হয়। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের কিছু অঞ্চলে বাঁদরদের আক্রমণে মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। --- বাঁদরের ইতিহাস: কিভাবে তারা বিবর্তিত হলো? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাঁদরের ইতিহাস লক্ষ লক্ষ বছর পুরোনো। তারা প্রায় ২৫-৩০ মিলিয়ন বছর আগে উদ্ভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে তারা গাছে বসবাসকারী প্রাণী ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিছু প্রজাতি মাটিতে চলাফেরা শুরু করে। বর্তমানে বাঁদরের দুইটি প্রধান শ্রেণি রয়েছে— 1. নতুন বিশ্ব বাঁদর (New World Monkeys) – মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়। এদের লেজ অনেক শক্তিশালী এবং এরা মূলত গাছে বসবাস করে। 2. পুরাতন বিশ্ব বাঁদর (Old World Monkeys) – আফ্রিকা ও এশিয়ায় পাওয়া যায়। এদের লেজ তুলনামূলক ছোট এবং এরা মাটিতেও চলাফেরা করতে পারে। --- উপসংহার বাঁদর আমাদের পৃথিবীর অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক সুপ্রাচীন এবং সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কখনো কখনো তারা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, তবুও তাদের আচরণ মূলত বাস্তুতন্ত্র ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। মানুষের উচিত বাঁদরের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করা, যাতে তারা টিকে থাকতে পারে। []